Thursday, April 5, 2012

আওয়ামী জাহেলিয়াতের যুগে বাংলাদেশে আক্রান্ত ইসলাম


মন্তব্য প্রতিবেদন : বাংলাদেশে আক্রান্ত ইসলাম

মাহমুদুর রহমান
দিন আগে অন্য একটি পত্রিকায় কর্মরত এক সিনিয়র রিপোর্টারের কাছ থেকে বাংলাদেশে ইসলামবিদ্বেষী মিডিয়ায় প্রচারণার এক বিস্ময়কর গল্প শুনেছি। একদিন পত্রিকাটির সম্পাদক ইসলামী জঙ্গিবাদেরপুনরুত্থানের ওপর জরুরি ভিত্তিতে একটা স্টোরি লিখতে নির্দেশ দিলেন। সাংবাদিকটি দেশের কোন জায়গায় নতুন করে এই জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছে, সেই তথ্য জানতে চাইলে সম্পাদক মহোদয় অগ্নিশর্মা হয়ে তাকে বললেন, জঙ্গি আছে কী নেই সেটা বিষয় নয়, স্টোরি লিখতে বলেছি, লিখে আনেন। বেচারা সিনিয়র রিপোর্টার বুঝতে পারলেন পেশাদার,স্বাধীনসম্পাদক মহাশয় মালিকের নির্দেশ পালন করছেন মাত্র। পত্রিকার মালিকও হয়তো সরকারের ওপর মহল কর্তৃক বিশেষ উদ্দেশ্যে ধরনের প্রচারণা চালানোর জন্য নির্দেশিত হয়েছেন।
আমার পত্রিকা অফিসে বসে সেই সিনিয়র রিপোর্টার যেদিন এই ঘটনাটি বলছিলেন, তার আগের দিনেই চরম মুসলমানবিদ্বেষী এক মৌলবাদী খ্রিস্টান যুবক নরওয়ের রাজধানী অসলোতে গুলি চালিয়ে এবং বোমা ফাটিয়ে প্রায় একশস্বদেশীকে হত্যা করেছে। তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সে নাকি ইউরোপকে মুসলিম অধিগ্রহণ থেকে রক্ষা করারমহানউদ্দেশ্যেই এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। এই সন্ত্রাসী কাণ্ডের পরসব মুসলমান সন্ত্রাসী নয়, তবে সব সন্ত্রাসী মুসলমান, ভারত পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী এবং আমাদের সুশীলদের (?) একাংশের এই প্রিয় তত্ত্বের কী হাল হবে, সেটি তারাই বিবেচনা করুক।
ইউরোপে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলা সম্পর্কে ইউরোপোল-২০০৯ প্রতিবেদন প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৬-২০০৮ সময়কালে ইউরোপে যতগুলো সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, তার মধ্যে মাত্র . শতাংশ মুসলিম উগ্রবাদী কর্তৃক পরিচালিত হয়। ২০০৬ সালে ৪৯৮টি ঘটনার মধ্যে মাত্র একটিতে, ২০০৭ সালে ৫৮৩টি ঘটনার মধ্যে ৪টিতে এবং ২০০৮ সালে ৫১৫টির মধ্যে শূন্যটিতে ইসলামিস্টরা জড়িত ছিল। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ৯৯. শতাংশ সন্ত্রাসী ঘটনার জন্য অমুসলিমরাই দায়ী।
আমার আজকের লেখার মূল বিষয়বস্তু বাংলাদেশ পরিস্থিতি বিধায় পাশ্চাত্য নিয়ে কথা আর না বাড়িয়ে স্বদেশের দিকে দৃষ্টিপাত করছি। বর্তমান সেক্যুলার সরকারের আড়াই বছরে বাংলাদেশে ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ঘৃণা ছড়ানোর লক্ষ্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চরম নিন্দনীয় যে কাজ-কর্মগুলো করা হয়েছে, তার মধ্য থেকে কয়েকটির দিকে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করছি।
. ২০০৯ সালের ২৮ মার্চসন্ত্রাস নিরসনে ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকাশীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক শামীম মোহাম্মদ আফজাল বলেছেন, পৃথিবীতে যত সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ রয়েছে, তার সবই ইসলাম মুসলমানদের মধ্যে (!) হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রিস্টানদের মধ্যে কোনো সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ নেই। হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রিস্টানরা সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত নয়।
. ২০০৯ সালের এপ্রিল এদেশের আওয়ামীপন্থী শিল্পপতিদের অর্থে পরিচালিত সুশীল (?) থিংক ট্যাংক বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট আয়োজিত ওয়ার্কশপে বক্তৃতায় বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছিলেন, কওমি মাদরাসাগুলো এখন জঙ্গিদের প্রজনন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। কওমি মাদরাসাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিস্তার লাভ করেছে। এসব কওমি মাদরাসায় যে শিক্ষা দেয়া হয়, তা কূপমণ্ডুকতার সৃষ্টি করছে।৭৫-পরবর্তী সামরিক শাসনামলে বিভিন্ন সংশোধনী এনে৭২-এর সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনাকে নস্যাৎ করার ফলেই এবং ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার পর ধর্মের নামে সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়েছে।
. ২০০৯ সালের ২৩ এপ্রিল বরিশালের নিউ সার্কুলার রোডের এক বাড়িতে ্যাব হানা দিয়ে বোরকা পরে ধর্মীয় শিক্ষার জন্য জড়ো হওয়ার অপরাধে ২১ নারীকে গ্রেফতার করে। ্যাব সাংবাদিকদের কাছে তাদের অভিযানের সংবাদ জানালে তা ফলাও করে ছাপা হয়। দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ শেষে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার কোনো তথ্য না পেয়ে ২১ পরহেজগার নারীকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে চালান দেয়া হয়। ঘটনার দীর্ঘ মাস পর ২৩ জুন আদালত তাদের বেকসুর খালাস দেন।
. ২০০৯ সালের ১৯ জুন রাজশাহীতে জঙ্গি সন্দেহে ১৫ নারী শিশুকে গ্রেফতার করা হয়। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ওইদিন বিকালেই মুচলেকা দিয়ে তাদের মুক্ত ঘোষণার পর আবার ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখানো হয়। পুলিশ গ্রেফতারকৃতদের সম্পর্কে ব্যাপক তদন্ত করেও জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার কোনো তথ্য পায়নি। শেষ পর্যন্ত আদালত তাদের বেকসুর খালাস দিলে জুলাই মাসের তারিখে ১১ দিন কারাবাস শেষে ১৫ জন নিরপরাধ নাগরিক মুক্তি পান।
. বোরকা পরার অপরাধে ২০০৯ সালের জুলাই পিরোজপুর জেলার জিয়ানগরে ছাত্রলীগের বখাটে কর্মীদের প্ররোচনায় পুলিশ জঙ্গি সন্দেহে তিন তরুণীকে গ্রেফতার করে। তারপর পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলে তিন তরুণীকে ঢাকায় টিএফআই সেলে নিয়ে আসা হয়। ৫৪ ধারায় গ্রেফতারকৃত তরুণীদের বিরুদ্ধে মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন অমর সিংহ। সময় তাদের বোরকা খুলতে বাধ্য করে মহাজোট সরকারের দিনবদলের পুলিশ। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদেও কোনো জঙ্গি সংযোগের কাহিনী বানাতে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ফাইনাল রিপোর্ট দিতে বাধ্য হয়। দীর্ঘদিন কারাগারে বন্দি থেকে অবশেষে তিন অসহায়, নিরপরাধ তরুণী মুক্তি পান।
. ২০১০ সালের এপ্রিল সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয় যে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান . একেএম শফিউল ইসলাম তার ক্লাসে ছাত্রীদের বোরকা পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। তিনি ক্লাসেমধ্যযুগীয় পোশাক বোরকাপরা যাবে না এবং এটি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের কোনো পোশাক হতে পারে না বলে ফতোয়া জারি করেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটি বিভাগীয় কোনো সিদ্ধান্ত নয়, তবে আমার ক্লাসে কোনো ছাত্রীকে আমি বোরকা পরতে দেব না।
. ২০১০ সালের আগস্ট বিশ্বশান্তি পরিষদের প্রেসিডেন্ট পরিচয়দানকারী জনৈক দেব নারায়ণ মহেশ্বর পবিত্র কোরআন শরিফের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন। রিট আবেদনে তিনি দাবি করেন, হযরত ইবরাহিম (.) তার বড় ছেলে ঈসমাইলকে (.) কোরবানির জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন বলে যে আয়াত পবিত্র কোরআন শরিফে রয়েছে, তা সঠিক নয়। তিনি দাবি করেন, হজরত ইবরাহিম তার ছোট ছেলে হজরত ইসহাক (.)-কে কোরবানি করতে নিয়ে যান। বিষয়ে সঠিক ব্যাখ্যা কোরআনের আয়াত শুদ্ধ করার জন্য দেবনারায়ণ মহেশ্বর আদালতের কাছে প্রার্থনা করেন। আদালত রিট খারিজ করে দেয়ার পর দেবনারায়ণের এই চরম হঠকারী উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ডে আদালতে উপস্থিত আইনজীবীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে পুলিশ দেব নারায়ণ মহেশ্বরকে কর্ডন সহকারে এজলাস থেকে বের করে তাদের ভ্যানে প্রটেকশন দিয়ে আদালত এলাকার বাইরে নিরাপদ অবস্থানে নিয়ে যায়।
. বিচারপতি এইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের দ্বৈত বেঞ্চ ২০১০ সালের ২২ আগস্ট স্বপ্রণোদিত (সুয়োমোটো) আদেশ প্রদান করেন যে, দেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অফিসে বোরকা পরতে বাধ্য করা যাবে না।নাটোরের সরকারি রাণী ভবানী মহিলা কলেজে বোরকা না পরলে আসতে মানাশিরোনামে ২২ আগস্ট একটি দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের বিচারপতিদ্বয় বোরকা পরিধানের বিরুদ্ধে সুয়োমোটো এই রায় দেন।
. ২০১১ সালের জুন সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের অন্যতম নেতা মেজর জেনারেল (অব.) কে এম শফিউল্লাহ দাবি করেন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, বিসমিল্লাহ ধর্মভিত্তিক রাজনীতি- তিনটির বিরুদ্ধে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। ওইদিন জাতীয় প্রেসক্লাবের মতবিনিময় সভা থেকে ঘোষণা করা হয় যে, সংবিধানে বিসমিল্লাহ রাষ্ট্রধর্ম থাকলে হরতাল দেয়া হবে।
১০. ২০১১ সালের ৩০ জুন সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী গ্রহণ করে আমাদের সংবিধানের মূলনীতি থেকে আল্লাহর ওপর আস্থা বিশ্বাস বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিস্থাপন করা হয়।
১১. ২০১১ সালের ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতৃভূমি টুঙ্গিপাড়া উপজেলার জিটি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক শঙ্কর বিশ্বাস দশম শ্রেণীর ক্লাসে দাঁড় রাখা নিয়ে সমালোচনাকালে হজরত মোহাম্মদকে (সা.) ছাগলের সঙ্গে তুলনা করেন। এতে ওই ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। পরে পুরো এলাকায় সাধারণ জনগণের মধ্যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে শঙ্কর বিশ্বাস টুঙ্গিপাড়া থেকে পালিয়ে যান।
১২. ২০১১ সালের ২৬ জুলাই ধানমন্ডি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষক মদন মোহন দাস মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এবং পবিত্র হজ নিয়ে কটূক্তি করেন। সহকর্মী শিক্ষকদের সঙ্গে এক সভায় তিনি মন্তব্য করেন,এক লোক সুন্দরী মহিলা দেখলেই বিয়ে করে। এভাবে বিয়ে করতে করতে ১৫-১৬টি বিয়ে করে। মুহাম্মদও ১৫-১৬টি বিয়ে করেছে। তাহলে মুসলমানদের মুহাম্মদের হজ্ব করা স্থান মক্কায় গিয়ে হজ না করে ওই ১৫-১৬টি বিয়ে করা লোকের বাড়িতে গিয়ে হজ করলেই তো হয়।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অন্তত ৮৫ শতাংশ যে জন্মসূত্রে মুসলমান নিয়ে সম্ভবত বিতর্ক নেই। সেই দেশে আড়াই বছর ধরে অব্যাহতভাবে ইসলাম, কোরআন, হাদিস এবং মহানবীকে (সা.) কটাক্ষ করার অভ্যাস চর্চার ফলে ইসলামবিদ্বেষ এখন সরকারের সর্বত্র প্রায় দুরারোগ্য ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে এবং এই ব্যাধির ভাইরাস ক্ষমতাসীন মহলের সব পর্যায়ের লোকজন অকাতরে বিতরণ করে চলেছেন। ইউরোপে অসুস্থ ইসলামবিদ্বেষ সর্বব্যাপী হয়ে ওঠার বিষক্রিয়াতেই নরওয়েতে অ্যানডার্স বেরিং ব্রেইভিক নামক খ্রিস্টান মৌলবাদী ঘাতকের উত্থান ঘটেছে। দীর্ঘদিন ধরেই ইউরোপে ইসলাম, মুসলমান এবং আমাদের মহানবীকে (সা.) বিকৃতভাবে উপস্থাপনের চর্চা চলছে। ডেনমার্কে হজরত মুহাম্মদকে (সা.) নিয়ে সাম্প্রদায়িক কার্টুন ছাপা এবং বাকপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে পাশ্চাত্যের জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশের এই অতীব নিন্দনীয় কর্মকাণ্ডকে সমর্থনের ফলে জন্মলাভ করা বিষবৃক্ষের স্বাদ তারাই আজ আস্বাদন করছে।
নরওয়ের সুবুদ্ধিপূর্ণ রাজনীতিবিদরা অবশেষে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন যে, এই ঘৃণ্য মানসিকতার আশু চিকিৎসা করা না হলে পশ্চিমের সমাজ রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। মধ্যযুগের ইউরোপে -জাতীয় অন্ধ ধর্মীয় ঘৃণা বিদ্বেষ বিকশিত হওয়ার ফলেই তখন সেখানে যাজকদের নির্দেশে ডাইনি আখ্যা দিয়ে নারীদের পুড়িয়ে মারা হয়েছে এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইউরোপের দেশে দেশে চরমপন্থী খ্রিস্টানদের হাতে ইহুদি ধর্মাবলম্বীরা নিগৃহীত, অত্যাচারিত হয়েছে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির মতো করেই আজ পূর্ব ইউরোপে ইহুদি বিদ্বেষ এবং পশ্চিম ইউরোপে ইসলামবিদ্বেষ দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। অসলো হত্যাকাণ্ডের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ইসলামবিদ্বেষী পশ্চিমা মিডিয়া কর্তৃক এর দায়ভার কথিত ইসলামী জঙ্গির ঘাড়ে চাপানোর দুর্ভাগ্যজনক অপচেষ্টাও আমরা লক্ষ্য করেছি। ১৯৯৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা সিটিতে এক ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় শত শত মার্কিন নাগরিক নিহত হলে সেখানেও প্রাথমিকভাবে মৌলবাদী মুসলমানদের দায়ী করা হয়েছিল। তার দিনের মধ্যেই প্রকৃত ঘাতক মৌলবাদী খ্রিস্টান টিমোথি ম্যাকভেই-এর নাম বিশ্ববাসী জেনে ফেলে।
২০০৮ সালে বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত সুশীল (?) বাংলা দৈনিকে মহানবী (সা.) এবং তাঁর সাহাবিকে কটাক্ষ করে ইউরোপের অনুরূপ ছড়া এবং কার্টুন ছাপা হলে দেশে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। জেনারেল মইনের তৎকালীন জরুরি সরকারের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিব উবায়দুল হকের কাছে উপস্থিত হয়ে পত্রিকাটির প্রখ্যাতসেক্যুলারসম্পাদকের জোড় হস্তে ক্ষমা প্রার্থনার ফলে সেই সময় ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ক্ষোভ খানিকটা প্রশমিত করা সম্ভব হয়েছিল। বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারীদের হৃদয়ে গভীরভাবে প্রোথিত নরওয়ের ব্রেইভিকের সমতুল্য ইসলামবিদ্বেষ সময়-সুযোগমত জনসমক্ষে প্রকাশ পায়। মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা প্রচার করলেও অন্তরে এদের অধিকাংশই চরমভাবে সাম্প্রদায়িক। এদের সাম্প্রদায়িকতা অবশ্য মূলত ইসলাম ধর্মবিরোধী। ইসলাম ছাড়া অন্য সব ধর্মমতের প্রতিই তাদের প্রগাঢ় শ্রদ্ধা। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের দাবি অনুযায়ী ডিজিএফআই কারসাজিতে মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন হলে বাংলাদেশে চিহ্নিত ইসলামবিরোধী গোষ্ঠীর এদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের ধর্মের বিরুদ্ধে সুসংগঠিত আক্রমণ চালানোর সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হয়। গত আড়াই বছরে ইসলাম ধর্মের প্রতি ঘৃণা ছড়ানোর প্রাথমিক কিছু নমুনা আমরা দেখতে পেয়েছি।
বাংলাদেশের অধিকাংশ নাগরিক যে বর্তমান সরকারের গণবিরোধী কর্মকাণ্ডে বীতশ্রদ্ধ হয়ে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছে, সেটি সম্ভবত নীতিনির্ধারকদের অজানা নয়। গত এক বছরের স্থানীয় সরকার পর্যায়ের সবকটি নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে যে কোনো নিরপেক্ষ বিশ্লেষক নিশ্চিতভাবেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন যে, মহাজোট সরকারের পায়ের তলায় আর মাটি নেই। জনসমর্থনহীন শাসকশ্রেণী যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য স্বাভাবিকভাবেই ক্রমেই অতিমাত্রায় বিদেশ নির্ভর হয়ে পড়ছে। দেশের স্বার্থ বিকিয়ে ভারতের সব অন্যায্য চাহিদা পূরণ করার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রতিবেশীর একমাত্র বিশ্বস্ত নির্ভরযোগ্য মিত্রে পরিণত হতে পেরেছেন। সুতরাং ধরে নেয়া যেতে পারে যে, ভারতীয় শাসককুল শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আসীন রাখার জন্য যথাসম্ভব প্রচেষ্টা চালাবে।
লন্ডনেরইকোনমিস্টে প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৮ সালের নির্বাচনেও ভারত মহাজোটকে টাকার থলি এবং এন্তার পরামর্শ দিয়ে নির্বাচনে জিততে সহায়তা করেছিল। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতায় একমাত্র ভারতের সহযোগিতায় বাংলাদেশের জনমতের বিরুদ্ধে ক্ষমতায় টিকে থাকা যে সম্ভব নয়, সেটা শেখ হাসিনার মতো ঝানু রাজনীতিবিদ অবশ্যই বোঝেন। ২০০৮-এর পরিস্থিতির মতো ভারতের সমর্থনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন যুক্ত হলে দেশের জনগণকে তখন মহাজোটের আর তোয়াক্কা না করলেও চলবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অব্যাহত ইসলামবিরোধিতা সম্ভবত সেই সমর্থন আদায়েরই কৌশল।
বাংলাদেশে সীমিত পরিসরে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছিল শেখ হাসিনারই আগের শাসনামলে। সেই দুর্ভাগ্যজনক চরম নিন্দনীয় জঙ্গিবাদও মাথাচাড়া দিয়েছিল আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটেই। আশির দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েট দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে কিছু বাংলাদেশী নাগরিকও যোগদান করেছিল। তারাই এদেশে মূলত জঙ্গিবাদের বীজ বহন করে নিয়ে এসেছে। এখানে উল্লেখ্য, সে সময় আফগানিস্তানের রণাঙ্গনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রগুলো তাদের আদর্শগত সোভিয়েট বিরোধিতার কারণে মুজাহিদদের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিল। ফলে আশির দশকে মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্য ইসলামিক রাষ্ট্র থেকে স্বেচ্ছাসেবকরা আফগানিস্তানে সোভিয়েট দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গেলে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব তাতে সায় দিয়েছিল। ২০০১ সালে খালেদা জিয়ার নির্বাচনে বিজয় লাভের ঠিক আগে নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে বিমান হামলা বিশ্বরাজনীতির হিসাব-নিকাশ সম্পূর্ণ পাল্টে দেয়। বিশ্বব্যাপী জোরেশোরে কথিত ইসলামী জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারণা শুরু হলে বাংলাদেশও তার প্রভাবমুক্ত থাকতে পারেনি। কাকতালীয়ভাবে একই সময়ে বাংলাদেশে শায়খ আবদুর রহমান বাংলাভাইয়ের রাষ্ট্র ধর্মবিরোধী জঙ্গি কর্মকাণ্ড এবং তাদের উত্থানের প্রাথমিক পর্যায়ে তৎকালীন সরকারের মধ্যকার এক ধরনের নির্লিপ্ততা পশ্চিমের সঙ্গে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের দূরত্ব সৃষ্টি করে। শেষপর্যন্ত খালেদা জিয়ার শাসনামলেই উভয় জঙ্গি নেতার গ্রেফতার তাদের বিচার সম্পন্ন হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর নীতিনির্ধারকরা তাতেও পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। যে কোনো বিচক্ষণ রাজনীতিবিদের মতোই শেখ হাসিনা প্রতিপক্ষের এই দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে প্রেসিডেন্ট বুশের কথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সঙ্গে প্রকাশ্যে একাত্মতা ঘোষণা করেন। সেই থেকে মার্কিন সমর্থন ধরে রাখার লক্ষ্যে শেখ হাসিনা তার ইসলামী জঙ্গি কার্ড অবিরাম খেলে চলেছেন। ফলে বাংলাদেশ আজ এমন একটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, যেখানে ইসলামবিরোধী নগ্ন প্রচারণা কোনো ব্যতিক্রম নয়; বরং দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা। যে সংবাদপত্রের ঘটনা দিয়ে আজকের মন্তব্য-প্রতিবেদন শুরু করেছি, তারাও সরকারের হুকুম তামিল করে চলেছেন মাত্র। উত্তরার ্যাব- হেডকোয়ার্টারে অবস্থিত টিএফআই সেলে রিমান্ডে থাকা অবস্থায় আমি নিজ চোখে শ্মশ্রুমণ্ডিত তরুণ এবং মধ্যবয়সীদের সেখানে আটক দেখতে পেয়েছি। তাদের গোঙানির শব্দ থেকে নির্যাতনের মাত্রাটাও খানিক আন্দাজ করতে পেরেছি। দিন পরপর টেলিভিশনের পর্দায় ইসলামী জঙ্গি নাম দিয়ে যাদের আটক দেখানো হয়, তাদেরও হয়তো উপরের নির্দেশে প্রয়োজনমাফিক টিএফআই সেল মার্কা নির্যাতন কেন্দ্রগুলো থেকেই সরবরাহ করা হয়। এর মাধ্যমে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গি দমনে তার অপরিহার্যতা প্রমাণের চেষ্টা করছেন।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ইউনূসকে সরকার চরমভাবে অপমানিত করায় সরকারের সঙ্গে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের যে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে, নিয়মিতভাবে জঙ্গিনাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের নীতিনির্ধারকরা সেই দূরত্ব কমানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। তাদের মূল লক্ষ্য সম্ভাব্য গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেতা এরশাদকে সঙ্গে নিয়ে আগামী ভোটারবিহীন একদলীয় নির্বাচনের আন্তর্জাতিক বৈধতা লাভ। ২০০৮ সালে নির্বাচনের মাত্র মাসখানেক আগে দেশে ফেরার সময় শেখ হাসিনা ওয়াশিংটনে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তৎকালীন বুশ প্রশাসনকে প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়ে নির্বাচনে ফায়দা লাভে সমর্থ হয়েছিলেন। বাংলাদেশে আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে যাবে। সেই নির্বাচনে যিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হোন না কেন, এখানে শেখ হাসিনা তার গতবারের সফল ইসলামী জঙ্গি কার্ডই যে ব্যবহার করবেন, সেটা নিশ্চিত।
সাম্য শান্তির ধর্ম ইসলামে জঙ্গিবাদ যে সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য, নিয়ে ইসলামের প্রকৃত আদর্শে বিশ্বাসীদের মধ্যে কোনো মতবিরোধ নেই বলেই আমার ধারণা। কিন্তু একই সঙ্গে জালিম শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোও একজন ঈমানদার মুসলমানের কর্তব্য। বাংলাদেশে কল্পিত ইসলামী জঙ্গিতত্ত্ব বিদেশে ফেরি করে যারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের ঐক্যবদ্ধ হয়েই মিথ্যা প্রচারণার জবাব দিতে হবে। ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতায় বিমোহিত হয়ে যারা আমাদের সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস আস্থা সরিয়ে ফেলার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন, তাদের নরেন্দ্র মোদীর গুজরাটের দিকে দৃষ্টিপাত করতে অনুরোধ জানাই। বাংলাদেশে আড়াই বছর ধরে যা ঘটে চলেছে, তার উল্টোটি গুজরাটে ঘটলে সেখানে অসহায় সংখ্যালঘুদের ভাগ্যে কী হতো, তার নমুনা ২০০২ সালে দেখা গেছে। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা লেখা থাকলেই যে জনগণ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী হয় না, তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ প্রতিবেশী ভারত। অপরদিকে সংবিধানে বিসমিল্লাহ এবং আল্লাহর ওপর আস্থা বিশ্বাস লিপিবদ্ধ থাকলেই যে দেশের নাগরিকরা সাম্প্রদায়িক হয়ে পড়েন না, তার উজ্জ্বল উদাহরণ আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মিলে-মিশে থাকা বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর হাজার বছরের ঐতিহ্য। আশা করি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ঘৃণ্য কৌশল হিসেবে ক্ষমতাসীনরা ধর্মনিরপেক্ষতার ছদ্মাবরণে ইসলামবিরোধী সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলবেন না।
(আমার দেশ, ১০ আগস্ট ২০১১ এর সৌজন্যে)

No comments:

Post a Comment